গাজী মামুন (নিজস্ব প্রতিনিধি)
৭১’ এ জীবন বাজী রেখে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জয়নাল আবেদীন ছিলেন সেসময়ে টগবগে এক তরুণ । সেই সময় দেশটা ছিল উত্তাল, বাংলাকে নিজের রূপে রূপ দেওয়ার নেশায় কাপছিল পুরো বাংলা। পাকিস্থানীদের শোষণ আর ব্যভিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এদেশের আপামর জনতা। ঠিক তখনি জয়নাল আবেদীন জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশকে রক্ষার্থে ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীকার আদায়ের আন্দোলনে মুক্তিবাহিনীদের সহযোগী হিসেবে। কুমিল্লা জেলার লালমাই উপজেলার বাগমারা দক্ষিণ ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামের মৃত হাসমত আলীর সন্তান জয়নাল আবেদীন। বয়স প্রায় ৫৮ বছর। বর্তমানে নিজ গ্রামেই থাকেন পরিবার নিয়ে।
যুদ্ধকালীন ২নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর হায়দার। মুক্তিযোদ্ধা সফিকুর রহমান মাস্টার (ভাবকপাড়া), জাফর উল্লাহ মাস্টার (জয়নগর), আবদুল খালেক, সোবহান মিয়া (পোহনকুচা), হানিফ মিয়া (ফতেহপুর), আবুল মিয়া (আলীশ্বর), কেরামত আলী (জয়নগর), তিত্ত বাবু (আলীশ্বর), দেলোয়ার দেলুর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন জয়নাল আবেদীন। বিভিন্ন সময় মুক্তিযোদ্ধাদের গুপ্তচর হিসেবেও কাজ করেছেন, পাকিস্তানিদের অবস্থান কখন কোথায় কিভাবে ছিল তার তথ্য দিতেন মুক্তিবাহিনীর কাছে। এছাড়া মুক্তিবাহিনীর খাওয়া-দাওয়া সহ থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন।
জাতীয় বীর আলহাজ্ব এম এ সামাদ সরকার কর্তৃক স্বাক্ষরিত দেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের সহযোদ্ধা হিসেবে সনদপ্রাপ্ত হন। যার সনদ নম্বর খ/১২২৩০। অতি দুঃখের বিষয়, জয়নাল আবেদীন মুক্তিযুদ্ধে অবদান সরূপ সহযোদ্ধা সনদ পেলেও অদ্যবদিও স্বীকৃতি পায়নি। দেশ স্বাধীনের ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও কোন সরকারি সুযোগ-সুবিধা কিংবা সহযোদ্ধা স্বীকৃতি পায়নি বলে তার অভিযোগ।
প্রতিবেদককে জয়নাল আবেদীন জানান, কুমিল্লা জেলার লাকসাম থানাও ১১ টি সেক্টরের একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে ছিল। ১৯৭১ সালের ১৫ ই এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা প্রথমে লাকসাম ক্যাম্প করার উদ্দেশ্যে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ৮ থেকে ১০ হাজার আর্মি রওনা হয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল লাকসাম বাজারকে দখলে নিয়ে লাকসামের সিগারেট ফ্যাক্টরীতে স্থায়ী ক্যাম্প করে এখান থেকেই চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণ করবে। যুদ্ধকালীন এ পাকবাহিনীকে দমন করতে বর্তমান লালমাই থানাধীন জয়নগর-আলীশ্বর এলাকায় ৪ টি সশস্ত্রবাহিনী গঠিত হয়: ( বেঙ্গল রেজিমেন্ট, আনসার, ইপিআর, পুলিশ)। এ বাহিনীর নেতৃত্ব দেন ১। আবুল কালাম মজুমদার (সংগ্রাম কমিটির সদস্য), ২। আবদুল করিম চৌধুরী ৩। চাঁন মিয়া সাহেব ৪। সুবল শাহ সহ আরো অনেকে। সাব সেক্টর আবুল বাশার, আর্মি রিটার্ড আলী আশ্বাব, আর্মি সৈনিক ফজর আলী তাদের নেতৃত্বে অস্থায়ী কমিটি গঠিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৫ ই এপ্রিল পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার সৈন্য কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে গাড়ি বহর করে কুমিল্লার লাকসাম সড়ক দিয়ে লাকসাম যাওয়ার পথে জয়নগর- আলীশ্বরের মধ্যে গতিরোধ করলে প্রতিরোধ যুদ্ধ আরম্ভ হয়। সকাল আনুমানিক ৮ ঘটিকার সময় যুদ্ধটি সংগঠিত হয়। ফলে জয়নগর, আলীশ্বর, পোহনকুচা, ফতেপুর, বরল, বরইয়া, কাঁকসার, শাঁনিচো অতর্কিত যুদ্ধ সংগঠিত হয়। জয়নগর রাস্তার দু’পাশে বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ করে, এরপর জয়নগর থেকে উত্তরে এক মাইল দক্ষিণে দুই মাইল পূর্বে, এক মাইল পশ্চিমে পাকিস্তানিরা ছড়িয়ে পড়ে এবং খুব মারাত্মক আকারে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধটা একনাগাড়ে সকাল থেকে বিকেল প্রায় ৪ টা পর্যন্ত চলে। ৪ টার সময় পাকিস্তানিরা জয়নগর মসজিদের সামনে সবাই একত্র হয়ে খাবার খাওয়ার জন্য তখন আশকামতা পুকুরপাড় বাংকার থেকে সংগ্রাম পরিষদ বাহিনীরা পাকিস্তানি সৈন্যদের লক্ষ্য করে আটিলারি বোমা মারলে জয়নগর মসজিদের সামনে অগণিত পাকিস্তানি সৈন্য নিহত ও আহত হয়। রাস্তায় রক্তের বন্যা বয়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর পাষন্ডতা ও নির্মমতার স্বাক্ষী আমাদের জয়নগর আলীশ্বর । জয়নগর-আলীশ্বর সহ আশেপাশের গ্রামের অগণিত লোক (প্রায় দুইশত থেকে তিনশত) গণশহিদ হয় এবং জয়নগর গ্রাম সহ আশেপাশের গ্রামের সকল বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি বাহিনীরা। রেহাই পায়নি নারী, শিশু,আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা।
জয়নাল আবেদীন দেশ স্বাধীন পরবর্তী সময়ে সহযোদ্ধা হিসেবে কয়েকটি সার্টিফিকেটই পেয়েছে। যা এখনো তার স্মৃতি হয়েই আছে। শেষ বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ সহযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে মৃত্যুবরণ করতে চায়, এটাই এখন জয়নাল আবেদীনের আকুতি।
আরো পড়ুনঃ